ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে বিভিন্নভাবে এস আলম গ্রুপের বেনামে ১৯ হাজার ৩৭৬ কোটি ঋণ নেওয়ার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির মোট ঋণের যা প্রায় ৭১ শতাংশ। ঋণের এক টাকাও আর ফেরত আসেনি। এদিকে সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম এবং তাঁর ভাই ও আত্মীয়স্বজনের নামে থাকা আমানত বিভিন্ন কৌশলে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ব্যাংকটির বাদ পড়া এমডিও আমানত ভাঙিয়ে ফেলেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলমান পরিদর্শনে এমন তথ্য উদ্ঘাটন হয়েছে। এমন এক সময়ে এস আলম গ্রুপের লোকজনের আমানত সরানোর তথ্য মিলেছে, যখন ব্যাংকটি ক্ষুদ্র গ্রাহকদেরও টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ অবস্থায় ব্যাংকটিকে তারল্য সহায়তায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি না দেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিদর্শক দল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ঋণ রয়েছে ২৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এস আলমের গ্রুপের বেনামে ২৪৭টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত ঋণসীমা ছিল ১১ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। কিন্তু দেওয়া হয়েছে ১৭ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির পান্থপথ শাখায় এস আলম গ্রুপের একজন কর্মচারীর নামে ১১৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। গ্রুপটির সুবিধাভোগীদের ৭৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার ১৯টি মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ৮৫৩ কোটি ২৫ লাখ ঋণ দেওয়া হয়েছে। কোনো আমানত না থাকার পরও ‘ওভারড্রাফট সুবিধা’ নামে আরও ১ হাজার ১৭৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বের করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ ঋণ দেওয়া যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুল আলম মাসুদের নামে চট্টগ্রামের মুরাদপুর এবং বন্দরটিলা শাখায় ৮ কোটি ২০ লাখ টাকার দুটি মেয়াদি আমানত ছিল। গত ১১ আগস্ট চার শাখায় লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ওই আমানত অন্য হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। মুরাদপুর ও বন্দরটিলা শাখা থেকে প্রথমে খাতুনগঞ্জ শাখা এবং পরে আগ্রাবাদ শাখায় এস আলম অ্যান্ড কোম্পানির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ডিটি রোড শাখায় রাসেল এন্টারপ্রাইজের নামে ৪ কোটি ২০ লাখ এবং বহদ্দার হাট শাখায় কোভ ট্রেডিংয়ের নামে ৪ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত রাখা হয়। এস আলমের ভাই রাশেদুল আলমের নামে কদমতলী শাখায় ৮ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত ছিল। গত ১৪ আগস্ট ও ১৮ সেপ্টেম্বর তা নগদায়ন করে আবার আজিজুন্নেছা ও রাশেদুল করিম চৌধুরীর নামে রাখা হয়েছে। তাঁর শ্যালক আরশাদ মাহমুদের ৪ কোটি ২২ লাখ, আত্মীয় আনসারুল আলম চৌধুরীর দেড় কোটি এবং গোলাম সারোয়ার চৌধুরীর ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকার আমানত তুলে ফেলেছে। এস আলমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট টপ টেন ট্রেডিং হাউস তিনটি শাখা থেকে ৩২ কোটি ২৭ লাখ টাকার মধ্যে ১২ কোটি ২৯ লাখ টাকা নগদ তুলে নিয়েছে। বাকি টাকা বিভিন্ন নামে ৫০টি এফডিআর করা হয়েছে।
ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করে পলাতক তৎকালীন এমডি এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর নামে গুলশান শাখায় ২ কোটি ৩২ লাখ টাকার পাঁচটি এফডিআর ছিল। গত ৩, ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর পুরো টাকা নগদে তুলে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাতুরীর মাধ্যমে আমানতকারীর অর্থ সরানোর সঙ্গে এমডি, মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান, সিএফও, ট্রেজারি প্রধান এবং শাখার কর্মকর্তারা জড়িত। পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন হলেও গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও শাখা এস আলম গ্রুপের সহযোগীদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
এতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ইউনিয়ন ব্যাংক বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ করতে পারছে না। গত ৬ অক্টোবর সিআরআর ঘাটতি ছিল ৬৭৭ কোটি টাকা। আগস্ট শেষে এসএলআর ঘাটতি ছিল ৬১০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বন্ডে বিনিয়োগ থাকা পুরো ৪৯৭ কোটি টাকা লিয়েন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের
চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৭ আগস্ট ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালন পর্ষদ ভেঙে এস আলমের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করেছে।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ব্যাংকের সাবেক এমডি এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরীকে টেলিফোন করে পাওয়া যায়নি। এস আলম গ্রুপের দায়িত্বশীল সবাই পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। সুত্র,সমকাল
পাঠকের মতামত